ভারত কি রোয়ান্ডা হতে চলেছে?
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ৩০ অক্টোবর ২০১৮, ১২:৩৫
ভারতের আসাম রাজ্যে বিশেষভাবে এবং অন্যান্য স্থানে সার্বিকভাবে মুসলিমবিরোধী উত্তেজনা চলছে। এ প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার কলকাতাভিত্তিক আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। তাজুদ্দিন আহমেদের 'অনুপ্রবেশকারী এবং উইপোকা' শীর্ষ লেখাটি এখানে প্রকাশ করা হলো
বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ কিছু দিন আগে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের উইপোকার সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন যে, তারা ভারতবর্ষের দরিদ্র মানুষের জন্য বরাদ্দ অন্ন ধ্বংস করে চলেছে এবং তাদের জন্যই দেশের তরুণ প্রজন্ম চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় এলে বিজেপি যে এই উইপোকাদের সমূলে উচ্ছেদ করবে সে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির সমালোচনা করতে গিয়ে উইপোকা প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন।
অনুপ্রবেশকারীদের উইপোকার সঙ্গে তুলনা করা নিয়ে জনমানস ও গণমাধ্যমগুলিতে তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গিয়েছে। প্রথমটি এই তুলনার মধ্যে যথেষ্ট যুক্তি খুঁজে পেয়েছে। বহু মানুষই মনে করেন যে অনুপ্রবেশকারীদের উইপোকার সঙ্গে তুলনা করার মধ্যে ভুল কিছু নেই, কারণ তারা উইপোকার মতোই নিঃশব্দে দেশকে ফোঁপরা করে ফেলছে। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে এই মতটিরই রমরমা দেখা গিয়েছে। দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়াটি এই তুলনাকে ঠিক মনে না করলেও একে গুরুত্ব দিতে রাজি নয় কারণ নির্বাচন-সর্বস্ব ভারতীয় রাজনীতিতে এমন অসংবেদী মন্তব্য বিরল নয়। তৃতীয় প্রতিক্রিয়াটি কিন্তু এই তুলনার মধ্যে দেখছে অশনি সঙ্কেত। উইপোকার সঙ্গে অনুপ্রবেশকারীদের তুলনা যে এই সব মানুষের মানবিক পরিচয়টি কেড়ে নিয়ে তাদের পরিহার্য প্রতিপন্ন করার চেষ্টা— সে দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছেন কিছু ইতিহাস-সচেতন মানুষ।
বিশেষ একটি গোষ্ঠীর মানুষকে পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ কিংবা মনুষ্যেতর জীবের সঙ্গে তুলনার উদাহরণ ইতিহাসে বিরল নয়। তত্ত্ব বলে, এর পোশাকি নাম ‘ডিহিউম্যানাইজ়েশন’ বা অবমানবায়ন। সাধারণত সবল এবং ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীগুলি দুর্বল অথবা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মানুষের অবমানবায়নের চেষ্টা করে। ব্যাপারটি জটিলতর হয় যখন এই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র অংশ নেয়। এটি আসলে বৃহত্তর একটি কার্যক্রমের অংশ।
এই কার্যক্রমের প্রথম ধাপে মানুষের বহু রকম সত্তা, অর্থাৎ জাতিগত, ধর্মীয়, লিঙ্গ, পেশা, ভাষা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থান ইত্যাদির মধ্যে যে কোনও একটিকে প্রাধান্য দিয়ে তাকে তার একমাত্র পরিচয় হিসেবে তুলে ধরা হয়। এতে সংখ্যা অথবা/এবং ক্ষমতায় গরিষ্ঠের তুলনায় বিশেষ সেই গোষ্ঠী কতটা আলাদা এবং কতটা নিকৃষ্ট তা প্রতিষ্ঠিত হয়। তত্ত্ব এই পদ্ধতির নাম দেয় ‘ডাইকটমাইজ়েশন’ বা দ্বিপ্রতীপকরণ।
নব্বইয়ের দশকে আফ্রিকার রোয়ান্ডাতে হুটু এবং টুটসি এই দুই গোষ্ঠীর ধর্মীয় (ক্যাথলিক) এবং ভাষাভিত্তিক (কিনরওয়ান্ডা) পরিচয় সরিয়ে প্রাধান্য পায় গোষ্ঠীগত পরিচয়। টুটসিরা আর রোয়ান্ডান টুটসি থাকে না, হয়ে ওঠে কেবলমাত্র টুটসি। একই ভাবে বিশ শতকের শুরুতে জার্মানিতে ইহুদিদের জার্মান পরিচয় দূরে সরিয়ে রেখে তাদের কেবলমাত্র ইহুদি বলেই চিহ্নিত করা হয়। এর পরের ধাপে ঘটে অবমানবায়ন। এই পর্যায়ে তাদের মনুষ্যেতর গণ্য করে পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ বা অন্য প্রাণীর সঙ্গে এক করার চেষ্টা চলে। রোয়ান্ডাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হুটুরা টুটসিদের চিহ্নিত করেছিল আরশোলা হিসেবে। হিটলারের জার্মানি ইহুদিদের চিহ্নিত করেছিল শূককীট, মাকড়সা অথবা গবাদি পশু হিসেবে।
নিজেদের অন্যান্য পরিচয় হারাবার পরেও যে পরিচয়টুকু থেকে যায় সেটি হল মানব পরিচয়। সেটিকেও কেড়ে নিলে তাদের সঙ্গে মানুষের মতো আচরণ করার কোনও দায় শক্তিমান সংখ্যাগরিষ্ঠের থাকে না। অনেক সময় সেই যুক্তিতে তাল মেলায় রাষ্ট্রশক্তিও। আরশোলা বা শূককীটের প্রয়োজন যেমন অস্বীকার করা যায়, তেমনই অনায়াসে তাদের জুতোর তলায় পিষে দেওয়া যায়। এই ভাবে ১৯৯৪ সালে রোয়ান্ডায় ক্ষমতাসীন হুটু জনগোষ্ঠী যে গণহত্যা সংগঠিত করে তাতে এক দিনেই ১০,০০০ টুটসি মানুষের মৃত্যু হয়। হিটলারের জার্মানিতে কত ইহুদির প্রাণ গিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, তা হলে কি ভারতবর্ষে গণহত্যার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে? এর উত্তরে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা যায় যে, সে রকম পরিস্থিতি এই দেশে এখনও আসেনি। তা হলে ইতিহাস-সচেতন মানুষের আশঙ্কাকে কি অতিরেক বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়? সেটি বোধ হয় করা যায় না কারণ তাতে ইতিহাসের শিক্ষাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হবে। রোয়ান্ডা, জার্মানি এবং দক্ষিণ আমেরিকাতে ঘর পুড়েছে।
অবমানবায়নের যে ইঙ্গিত খোদ রাষ্ট্রনায়ক এবং তার সেনাপতির কথায় শোনা গিয়েছে তাতে সিঁদুরে মেঘ না দেখার কারণ নেই। লক্ষণীয়, অনুপ্রবেশকারীদের কথা বলা হলেও তাদের ধর্মীয় পরিচয় এ ক্ষেত্রে অন্য সব পরিচয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু পরিগণিত হচ্ছেন শরণার্থী হিসেবে কিন্তু মুসলমানরা চিহ্নিত হচ্ছেন অনুপ্রবেশকারী হিসেবে। তার পর এর সঙ্গে সচেতন ভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে অবমানবায়িত পরিচয়, উইপোকা— যাকে ছুড়ে ফেলা যায় বা পিষে মারা যায় অনায়াসে। ফলে প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্বের বাস্তবায়ন যে শুরু হয়েছে বা চলছে তা অস্বীকার করা যায় না। বর্তমান ভারতবর্ষের ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা এবং গণপিটুনির মতো ঘটনায় রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা আমাদের আশঙ্কিত করে যে পরবর্তী পর্যায়গুলি হয়তো খুব দূরে নয়।